বিসর্জন - Bengali Story - Bangla Golpo
জলের ধারে বসে থাকতে থাকতে বিজয়ার অনেককালের কথা মনে পড়ছে আজ।
কোথাকার এই নদী,কোথাকার এই জল আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!তার জীবনও তাই!
"দোল দোল দুলুনি" ছড়ার বয়সে সে সিঁথি রাঙা করে এ বাড়িতে এসেছিল। পাঁচ বছরের মেয়ে বিয়ের কী বোঝে?
তবে সাজতে ভারী ভালো বাসত বিজয়া।
ওইটুকু বয়সেই নাকে নথ পড়তো টেনে, কানে ঝোলা দুল, শ্বশুরবাড়ির মেয়ে-ঝিরা তো কচি মেয়ের সাজের বহর দেখে হেসে খুন হত।
তার কিশোর বর একবার নথ ধরে নাড়া দিয়েছিল বলে বিজয়া সাত সাতটে দিন মান করেছিল।
শেষে একজোড়া পায়ের মল গড়িয়ে দিয়ে তার মান ভাঙানো গেল।
বর বলতে কতটুকু মনে পড়ে বিজয়ার?
সেই এক কিশোর ছেলে, এই এত্তো বড়ো বাড়িতে সেই ছিল তার খেলার সাথী।
অথচ খেলা কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল তাদের।
বিয়ের একবছর পর বিজয়ার স্বামী কিশোর ব্রজমোহন জমিদারির কাজে গিয়েছিল বায়রের গ্রামে।
নদী পেরোনোর সময় নৌকাডুবিতে মারা যায় সে।
ছয় বছরের বয়সে বৈধব্য এসে গ্রাস করল বিজয়ার সমস্ত সজ্জা,সুখ আনন্দের সামগ্রী। সেও প্রায় বারো তেরো বছর আগের কথা।
এতদিনে গায়ের চামড়ার সাথে এক হয়ে গেছে সাদা থানখানি।
তবুও দুর্দান্ত অষ্টাদশী যৌবন শরীরের সমস্ত বেড়া ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছে যেন।
বিজয়ার গায়ের রঙ শ্যামলা, বৈধব্যের কৃচ্ছসাধনে কিঞ্চিৎ কৃশ।
বড়ো বাড়ির বিধবা বিজয়ার দিন কাটে গোয়াল ঘর পরিষ্কারে, ঠাকুরঘরের জোগাড়ে।
যৌবনের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা ফুল ক্রমশ যেন শুকিয়ে উঠছে।
কেউ খোঁজ রাখছে না সে ফুলের, কেউ বলছে না একবারও -'জল খাবে ফুল, জল?'
এবছর শ্রাবনে বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে।
নতুন বউ কিশোরী, কিন্তু সুন্দরী।
অল্পদিনেই সে স্বামী ও নতুন সংসারের মনের মধ্যিখানে জায়গা করে নিয়েছে। আশ্বিনের মাঝামাঝি দুর্গাপুজো।
উৎসবের আনন্দে বড়োবাড়ি আত্মহারা হয়ে উঠেছে।
বাড়ির বউরা গা ভরা গয়না পরে ঠাকুর দালানে বসে আলতা পায়ে দিচ্ছে, সে দৃশ্য এ বাড়িতে চেনা।
অথচ বিজয়ার ভারী অসহ্য লাগছে এবার।
এতোবছর বৈধব্য নিয়ে এ বাড়ির পুজো দেখছে।
কিন্তু এবছর নতুন বউ আসায় সব যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। নতুন বউ স্বভাবতই সৌন্দর্যে অহংকারী, তার ওপরে স্বামী সোহাগিনী। সে আসা অবধি বিজয়াকে হীন চোখেই দেখেছে।
যদিও এবাড়িতে কেই বা তাকে হীন চোখে দেখে না।তবু এ দৃষ্টি যেন বড়ো আঘাতের।
কোথায় গিয়ে যেন বিজয়াকে মনে করিয়ে দিচ্ছে- "তুই বড়ো অভাগী।তোর স্বামী নেই,সুখ নেই, সোহাগ নেই।
অথচ ওই পুচকে ছোট বউ কেমন স্বামীর বুকে রাঙাকনে হয়ে তোর সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ধিক তোর আঠেরো বছরের যৌবন, ধিক তোর কৃচ্ছ্রসাধন বেঁচে থাকায়।"
বিজয়ার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তীব্র আত্মধিক্কার - "ধিক তোর আঠেরো বছরের যৌবন, ধিক তোর কৃচ্ছ্রসাধন বেঁচে থাকায়।"
দশমীর সকালে বাড়ির মেয়ে বউরা ঠাকুরদালানে উঠে মাকে বরণ করল।
উৎসবের শেষলগ্নে সিঁদুরখেলায় মেতে উঠল সারা বাড়ি।
বিজয়া ঠাকুরদালানে যায়নি, শুভকাজে বিধবাদের থাকতে নেই,তায় আবার সিঁদুরখেলা।
দুয়েকবার দালানের ওপর থেকে দেখেছিল রাঙা হয়ে যাওয়া সারা বাড়ি,সিঁদুররাঙা বউদের রাঙা মুখগুলো।
বিজয়া তখন গোয়ালের দিকে। সে দিকটা তখন নিরিবিলি, কেউ নেই। হঠাৎ বিজয়ার মনে হল গোয়ালঘরের পেছনে কারা যেন এসেছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দেখল সেখানে নতুন বউ, সাথ তার স্বামী বাড়ির ছোটছেলে।
বিজয়া একবার ভাবল চলে যাবে, অথচ পা যেন সেখানেই গাছের মতো শিকড় এঁটে বসল।
ছোটছেলে নতুন বউয়ের সিঁথিতে একমুঠো সিঁদুর মাখিয়ে দিল। নতুন বউয়ের তখন লজ্জাবনত মুখ।
আড়ালে বিজয়ার সর্বাঙ্গ তখন কোন এক অদ্ভুত আগুনে ক্রমশ পুড়ে যেতে লাগল।
যে সুধাস্বাদ কোনদিন পায়নি সে, সেই সুধার ভাণ্ড চোখের সামনে নির্লজ্জ নগ্নতায় এসে দাঁড়াল হঠাৎ।দুটো মানুষ ধীরে ধীরে নিবিড় হল নিরিবিলি কোণায়, তারা জানে না তৃতীয় ব্যক্তি ক্ষুধার্ত চোখ দিয়ে গ্রহণ করছে সে দৃশ্য।
বিজয়া আর পারল না। তার মনের গভীর থেকে সেই পুরাতন ধিক্কার ধ্বনি ঘুরপাক খেয়ে উঠতে লাগল -"ধিক তোর আঠেরো বছরের যৌবন, ধিক তোর কৃচ্ছ্রসাধন বেঁচে থাকায়।"
বিজয়া এখন দাঁড়িয়ে আছে জলের সামনে।
শরতের ভরা নদী পূর্ণযৌবনা রূপসীর মতো বয়ে চলেছে।
বিজয়া সারা গায়ে আজ গয়না পড়েছে।
সেকালের ভারী ওজনের বেশ কিছু গয়না আজ তার সাদাথানের ওপর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
সিঁথি রাঙা হয়ে উঠছে সিঁদুরে সিঁদুরে।
তার আজীবনের সোহাগ-সিঁদুরের সাধ মিটছে না আর।
বিজয়ার শ্যামবর্ণ মুখ উজ্জ্বল লাল হয়ে দেখা দিল।
গতজন্মের যাবতীয় না পাওয়া ফেলে দিয়ে বিজয়া আজ অপরূপা সেজেছে।
সম্মুখে রূপসী নদী দুহাত বাড়িয়ে সখীর মতো ডাকছে।
বিজয়া দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল জল, ক্রমশ নেমে যেত থাকল গভীরে....
কোথাকার এক রাজ্যে চলে যাচ্ছে বিজয়া।
সেখানে পরিতাপ নেই,আত্মধিক্কার নেই, নিত্যদিনের বেঁচে থাকার নামে একটু একটু করে মরে যাওয়া নেই।
সে রাজ্য থেকে বিজয়া শুধু আশা করে যেতে পারে, ভবিষ্যতের বিজয়ারা গা ভরা গয়না পরে, স্বামীর সোহাগ নিয়ে বাঁচতে পারবে। কোনও দশমীর বিকেলে বিসর্জন হবে না সেই বিজয়াদের।
ভালো থাক বিজয়ারা। ভালো থাক তাদের সুখে থাকার আকাঙ্ক্ষা। #শুভ_বিজয়া।।
-Anirban Mandal
Nice golpo
উত্তরমুছুনthnx, read others too
মুছুনKub dukker kahini eta
উত্তরমুছুন