একটি রাত তিনটি জীবন - ৪

 


_বাঃ, এটা তো খুব ভালো কথা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো সোমনাথ । আলতাফের কীধে হাত রেখে বললো, এটা যা বললে, তাতে আমি

সত্যিকারের খুশি হলাম । এমন করে ক'জন ভাবে? মাঝে মাঝে এসো, আলতাফ, তোমাকে দেখলে আমার

ভালো লাগবে ।


আলতাফ নিচু হয়ে আবার সোমনাথকে প্রমাণ করলো ।


এর কয়েকদিন পরেই এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যা প্রায় অলৌকিক বলা যায়। অলৌকিক নয়, কাকতালীয়,

শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবু এমন ঘটনাও হঠাৎ ঘটে ।


বাসবীর সঙ্গে দেখা করতে যাবার ইচ্ছেটা সোমনাথের মনের মধ্যে গুর্জুরিত হচ্ছে বটে, কিন্তু যাওয়াই হয় না।

ঠিকানা জোগাড় করেছে । গেলেই হয়, শুধু সময়ের অভাব নয়, আর একটা কিসের যেন বাধা রয়েছে।


তবু বাসবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।


বেলভিউ নার্সিং হোমে সোমনাথ একটা রাউন্ড দিতে গেছে রান্তির বেলা, তার দু'জন পেসেন্ট আছে ওখানে,

লিপটে তার কীধে হাত দিল বিশ্বদেব।


গন্তীর ভাবে সে বললো, বাসবীকে দেখতে এসেছি?


সোমনাথ বিস্মিতভাবে বললো, বাসবী? সে এখানে ভর্তি আছে নাকি? কী হয়েছে তার?


বিশ্বদেব বললো, তুই জানিস না? স্ট্যাব ইনজুরি


এবারে প্রায় জীতকে উঠে সোমনাথ বললো, স্ট্যাব ইনজুরি?


কে ছুরি মেরেছে বাসবীকে?


-তুই খবরের কাগজে পড়িসনি? কালকের কাগজেই তো বেরিয়েছে। রবিবার ছাড়া অন্যদিনের কাগজ ভালো

করে পড়াই হয় না। শুধু হেডিংগুলোয় চোখ বূলোয় সোমনাথ । সে বাসবীর খবর কিছু দেখেনি।


ব্যাপারটা অত্যন্তই বিশ্রী এবং রোমহর্ষক ।


মুর্শিদাবাদে বাসবীর এক দিদি থাকে, তার সঙ্গে সে দেখা করতে গিয়েছিল। ফিরছিল বিকেলের ট্রেনে । সেই

ট্রেনে মাঝপথে একটা ছোট স্টেশনে থেমে রইলো । কোথায় নাকি তার কাটা গেছে, কখন আবার ট্রেন চলবে

তার ঠিক নেই ট্রেন থেমে রইলে। কিছু কিছু যাত্রী নেমে চলে গেল, তারা অন্য জায়গা থেকে বাস ধরবে । বাসবী

সে সব চেনে না। ট্রেন এখনো চলার আশা আছে, তাকে ট্রেনেই ফিরতে হবে।


কামরার মধ্যে অসহ্য গরম । আলো, পাখা নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার । কিছু যাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করছে।

বাসবীও নেমে দীড়ালো এক সময়। স্টেশনটা অন্ধকার । বহুক্ষণ লোডশেডিং চলছে। বাসবীর অসহায় লাগছে,

কিন্তু কিছু করাই উপায় নেই।


অন্য যাত্রীদের ভিড় ছাড়িয়ে সে এক সময় এগিয়ে গিয়েছিল প্র্যাটফর্মের শেষ দিকটায়। হঠাৎ দেখলো, তাকে

ঘিরে ধরেছে তিনজন লোক । একজন বিড়বিড় করে কি যেন বললো। আর একজন কাছে এসে তার গলার

হারটা ধরে দিল এক টান । কিন্তু হারটা ছিড়ল না।


বাসবী তখন চেঁচিয়ে উঠতেই সেই তিন জন লোক বাসবীকে চেপে ধরে টানতে লাগলো বাইরে দিকে ।

একজনের হাতে ঝলসে উঠলো ছুরি, আর একজন একটা বোমা ফাটালো।


প্ল্যাটফর্মে কত লোক, কেউ এগিয়ে এলো না তাকে সাহায্য করতে । বোমার আওয়াজ শুনেই সবাই দৌড়ালো

অন্য দিকে । বাসবী প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলেও তিন জনের সঙ্গে পারবে কেন? একজায়গায়

রেলিং ভাঙ্গা, ওরা তাকে সেখান দিয়ে বার করতে চাইছে। মাঠের অন্ধকারে নিয়ে যেতে পারলে বাসবীকে আর

জ্যন্ত পাওয়া যেত না।


সেই সময় একটা লোহার ডান্ডা নিয়ে ছুটে এলো একটি মাত্র লোক। গুন্ডারা আর একটা বোমা ছুঁড়লেও সে

গ্রাহ্য করলো না। লোকটি যেমন গায়ে জোর, তেমনি সাহস। সে একা লড়ে গেল তিনজনের সঙ্গে । এই

হুড়োহুড়ির মধ্যে বাসবীর গলার কাছে একবার ছুঁড়ি বসে গেল, গুভ্ডারা সেই লোকটিকেও একবার ছুড়ি

মেরেছিল, কিন্তু সে লোহার ডান্ডা দিয়ে তিনজনকেই কাৎ করে ফেললো এক সময়।


একজন ধরা পড়েছে, অন্য দু'জন পালিয়েছে। সেই উদ্ধারকারী আহত হলেও গুরুতর কিছু নয়। সে ভর্তি

হয়েছে রেলের হাসপাতালে ।

বাসবীর গলার কাছে ব্যান্ডেজ বাধা, সে চিৎ হয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে। ব্যান্ডেজটার দিকে এক নজর তাকিয়ে

সোমনাথ বুঝলো, বাসবীর ক্ষত নিয়ে তেমন চিন্তার কিছু নেই।


সোমনাথকে দেখে বাসবী হাসলো ।


সোমনাথ টের পেল, তার বুকের মধ্যে, খুব গোপন কোনো জায়গায় সে বাসবীকে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন।

সে যে ভেবেছিল, বাসবীকে একেবারে মুছে ফেলেছে, তা তো ঠিক নয়। বাসবীকে দেখেই মৃদু-টনটনে ব্যথা

অনুভব করলো- কেন তা হলে?


বাসবীর একটা হাত ধরে সে বললো, তুমি এ সব লোকাল টেনে একলা ট্রাভেল করছিলে কেন?


বাসবী বললো, বাঃ ট্রেনে তো কত লোকই একলা যায়। আমার এখন একলা বেড়াতেই ভালো লাগে ।

সোমনাথ বললো, দেশের অবস্থা তো জানো না। তোমার মতন একটি সুন্দরী মেয়েকে একলা দেখলেই গুন্ডারা

স্পট করে। ওরা নিশ্যয়ই তোমার ওপর নজর রেখেছে অকেক্ষণ। তারপর যেই একটু নিরালায় পেয়েছে।

বিশ্বদেব বললো, ঠিকই বলেছিস, সোমনাথ । বাসবী, তোমার একলা আসা উচিত হয়নি। তুমি যে ফ্ল্যাটে একলা

থাকো, সেখানে কোনো ভয় নেই তো?


বাসবী বললো, সেখানে কোনো ভয় নেই। কোনো অসুবিধা নেই।


-একলা কি সারা জীবন কাটাতে পারবে?


-তা জানি না। এখন দিব্যি আছি।


বিশ্বদেব বা সোমনাথ কেউই বলতে পারবে না, আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে থাকবো । ওদের সংসার আছে। সেই

সংসার ওরা ভাঙ্গবে না।


একটুক্ষণ গল্প করার পর বিশ্বদেব বললো, আমি ঘুরে আসছি। আমার একজন পেসেন্ট-এর বেশ ক্রিটিক্যাল

কভিশান। পালাসনি, সোমনাথ আমরা একসঙ্গে ফিরবো ।


এখন বাসবী আর সোমনাথ মুখোমুখি । একটি নার্স ঢুকেও আবার বেরিয়ে গেল। সোমনাথ কী কথা বলবে,

খুঁজে পাচ্ছে না। দু'জনে দু'জনের হাত ধরে আছে, দুটি হাতই উষ্ণ ।


বাসবী বললো, একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার কী জানো তো, সোমনাথ? যে লোকটা আমাকে বাচাতে এসেছিল, সে

তো প্রথমে আমাকে ভালো করে দেখেইনি। এমনিই একটি মহিলা বিপদে পড়েছে দেখে সে ছুটে এসেছিল।

আর কেউ আসেনি, এ লোকটি রেলে চাকরি করে, দারুণ সাহস, একেবারে শেষ কালে আমাকে ভাল করে

দেখে সে বললো, দিদি, আমি তো আপনাকে চিনি। একসময় আপনি বীকুড়ায় ছিলেন না? আমিও বাঁকুড়ায়

থাকতাম । আমার নাম আলতাফ মন্ডল । আমি অবশ্য ওকে চিনতে পারলাম না। কিন্তু ও আমাকে চেনে ।

সোমনাথের ঠোটে হাসি ফুটে উঠলো । একেই কি মিরাকল বলে?


সে অস্ফুট স্বরে বললো, ২৪ শে জুলাই, ১৯৯২, তোমার মনে আছে সেই দিনটা?


বাসবী বললো, বাঃ মনের থাকবে না?


সোমনাথ মনে মনে বললো, এ একটা রাতে তিন জন মানুষের জীবন বদলে গেছে। একটু এদিক ওদিক হলেও

এই তিনজন মানুষের জীবন অন্য রকম হয়ে যেতে পারতো ।


বাসবী জিজ্ঞেস করলো, হঠৎ এ দিনটার কথা বললে কেন?


সোমনাথ আবার মনে মনে বললো, সেইদিনটা আর ফেরানো যায় না।


মুখে বললো, তোমার মনে আছে কি, সেই রাতে একতলার বারান্দায় শুয়ে একটা অসুস্থ লোক খুব কাশছিল?

সেই শব্দে তুমি ঘুমোতে পারোনি? সেই লোকটিই আলতাফ মন্ডল । ওর জন্য তুমি ঘুমোতে পারোনি, তোমার

কষ্ট হয়েছিল, তাই আলতাফ তোমার কাছে খণ শোধ করে গেল।

সমাপ্ত

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন