বাসবী বললো হ্যা। তুমি আমাকে একবারও বসতে বললে না? সোমনাথ ইতস্তত করে বললো, তুমি আমার এখানে... রাত হয়ে গেছে .... আমি একটু ড্রিংক করেছি।
খিলখিল করে হেসে উঠলো বাসবী।
রাত্রির নিস্তবদ্ধতায় যেন ছুরি বিধিয়ে দিতে লাগলো সেই হাসি। সে নিজেই চেয়ার টেনে বসে বললো, আমি
একটু হুইস্কি খাবো ।
একটা গেলাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে দিল সোমনাথ । তার কপালে চিন্তার রেখা । নির্জন বাড়িতে, তার ঘরে
এক যুবতী এসেছে, অথচ সে খুশি হয়নি । বাসবীকে সে চলে যেতেও বলতে পারছে না।
পাতলা পোশাকে তার শরীরের রেখা স্পষ্ট। বুকের অনেকটা দেখা যায়। নিজের শোবার ঘরেই মেয়েরা
সাধারণত এরকম পোশাকে থাকে ।
হুইফ্কির গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে বাসবী বললো, এইরকম বৃষ্টি রাতে আমার ঘুম আসে না, খুব গান শুনতে
ইচ্ছে করে। তুমি একটা গান শোনাবে সোমনাথ?
সোমনাথ বললো, গানঃ আজকাল তো গান গাই না। ভুলেই গেছি সব।
বাসবী বললো, লন্ডনে গোল্ডার্স গ্রীনে দুর্গাপুজোর ফাংশানে তুমি অনেকগুলি গান গেয়েছিলে ৷ একটা গান আমার
দারুণ ভালো লেখেছিল। “্বপ্নে আমার মনে হলো, তুমি ঘা দিলে আমার দ্বারে... ।' এই গানটা অন্য কারুকে
গাইতে শুনলেও তোমার কথা মনে পড়ে । এই গানটা তোমার চেয়ে আর কেউ ভালো গাইতে পারে না।
সোমনাথ একটু হেসে মুখ নিচু করে বললো, কী যে বলো । আমি কি কখনো গান শিখেছি।
_এ গানটা একবার গাইবে, সোমনাথ?
_বাসবী, তোমার স্বামী আমার স্কুলের বন্ধু । আমি দুর্বল।
এত রাতে তুমি আমার এত কাছে বসেছো। আমার বুক টিপ টিপ করছে। এই অবস্থায় কি গান হয়?
-আমি কিন্তু তোমাকে একটু ভয় দেখাই না। আমি বুঝি আলাদা করে তোমার বন্ধু হতে পারি না? বিনায়ক
মাঝে মাঝে এরকম রাত্তিরের দিকে সিক্কের লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসে না? আমি
মেয়ে, তাই আমার সে অধিকার নেই?
-থিয়োরিটিক্যালি তোমার কথাটাই ঠিক। পুরুষ আর মেয়েদের তবু আমি একচোখে দেখতে পারি না। সব
মেয়েকেও শুধু মেয়ে বলে মনে করা যায় না। ধরো যদি এখানে মিসেস অনিমা হালদার আসতেন, তাহলে কি
আমি ঘাবড়াতাম?
-তা হলেও তোমার বুক টিপ টিপ করতো । তুমি মিসেস হালদারকে খুব ভয় পাও, আমি দেখেছি।
-সে অন্য কারণে ভয় পাওয়া। উনি কথা বলতে আরম্ত করলে থামতে চান না।
_তুমি কি চাও, আমি চলে যাই, সোমনাথ?
-আমি কী চাই? হ্যা, তোমার এখন চলে যাওয়াই উচিত। অথচ আমার মন তীব্রভাবে বলছে, না তুমি থাকো,
থাকো, থাকো ।
বাসবী উঠে দীড়ালো। জানালার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখলো। এরকম একটানা বৃষ্টি বহুদিন দেখা যায়নি।
মনে হয় যেন সারা পৃথিবী জুড়েই এখন বৃষ্টি পড়ছে।
গরম একেবারেই নেই, তবু যেন ঘামে চকচক করছে সোমনাথের কপাল । সে একটা সিগারেট ধরালো।
পাশেই সোমনাথের বিছানা । চেয়ারে বসার বদলে সে বিছানায় চলে যেতে পারে । বাসবীকে ডেকে নিতে পারে
পাশে। এখন কেউ আসবে না। কেউ কিছু জানবে না। এই বৃষ্টির রাতটা একটা স্বপ্নের মতন কেটে যেতে
পারে । তারপর সকালবেলা সব ভূলে গেলেই হলো।
পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে বাসবীর । চওড়া পিঠ, সরু কোমর, ভারি নিতম্ব । দারুণ ওর শরীরের গড়ন। লন্ডনে
প্রথমে তারই আলাপ বাসবীর সঙ্গে। বিনায়ক আর সোমনাথ দু'জনেই একসঙ্গে কাজ নিয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে,
সোমনাথের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, সে স্ত্রীকে নিয়ে যায়নি, প্রথম দিকে বিনায়ক তখনো বিয়ে করেনি । বাসবী
তখন পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী, তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে নাচে। বাঙালি সমাজে নাচিয়ে হিসেবেই তার
বেশ নাম ছিল। তরুণ দুই ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় কিছুদিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতায় পৌছলো। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে
বাসবীর নাচের সঙ্গে সোমনাথ গান গেয়েছে।
ওরা তিনজনে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেত। সোমনাথ যেদিন টের পেল বাসবী তার দিকেই বেশি ঝুঁকছে,
সেদিনই সে জানিয়ে দিল যে, সে বিবাহিত। এ কথা গোপন করার কোনো মানে হয় না। তারপর থেকে
তিনজনে একসঙ্গে কোথাও যাবার কথা থাকলে সোমনাথ শেষ মুহুর্তে ইচ্ছে করে যেত না। বিনায়ককেই সুযোগ
দিত সে।
লন্ডনেই বিনায়কের সঙ্গে বাসবীর বিয়ে হয়ে গেল। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে গেল সোমনাথ । বাসবী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর
স্ত্রী, তার সঙ্গে ইয়ার্কি রসিকতা করা যায়। তার বেশি কিছু নয়। বিশ্বাসটাই তো বন্ধুত্রে প্রধান শর্ত ।
সোমনাথ মাঝে মাঝে রাত্তিরে যেত বিনায়ক-বাসবীদের বেলসাইজ পার্কের আযাপাটমেন্টে। নতুন নতুন রান্নার
এক্সপেরিমেন্ট এবং গান-বাজনায় কেটে যেত চমৎকার সময় ।
ওদের বিয়ের মাত্র মাস ছয়েক পরে এক রাতে, বাসবী একটা মারাত্মক ইঙ্গিত দিয়েছিল । জানুয়ারি মাস, অসম্ভব
ঠান্ডা পড়েছে, হাসপাতাল থেকে বাস ধরে ফেরার পথে সোমনাথ আর বিনায়কের হাত-পা, প্রায় জমে যাবার
অবস্থা। ওরা কেউ তখনো গাড়ি কেনেনি। বাস থেকে নেমে, বিনায়কের বাড়ি পর্যন্ত যেতে বেশ খানিকটা
হাটতে হয়। সেদিন বেশি মদ্যপান হয়ে গিয়েছিল । বিনায়ক সহ্য করতে পারেনি, এক সময় একেবারে অজ্ঞান ।
খেলনা কিছুই, ওকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেয়া হল।
তারপর সোমনাথ আর বাসবী গল্প করলো অনেক রাত পর্যন্ত । দু"খানা ঘরের আ্যাপাটমেন্ট, তার মধ্যে একখানা
ঘর সোমনাথ এসে প্রায়ই দখল করে । সেই রাতে সোমনাথ আলো নিভিয়ে শুতে যাবার একটু পরেই বাসবী
এসে তার ঘরের আলো জ্বালালো।
বাসবীর ঘুম নেই চোখে, সে সোমনাথের কাছে থাকতে চায়। বাসবীর চোখ-মুখ দেখেই সোমনাথ বুঝতে
পেরেছিল, বাসবীর নীতিবোধ অন্যরকম ।
সোমনাথ তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বলেছিল, তোমার ঘুম আসছে না। চলো, আমরা বসবার ঘরে
গিয়ে গল্প করি। আমি ইচ্ছে করলে জেগে থাকতে পারি সারারাত ।
বাসবীর থেকে অনেকখানি দূরত্ রেখে বসেছিল সোমনাথ । সত্যি সত্যি নানারকম গল্প হলো।
বাসবীকে সে বৃঝিয়ে দিয়েছিলো, বন্ধুর নববিবাহিতা স্ত্রী'র সঙ্গে শারীরিক ফুর্তি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাসবী
রাগ করেনি, মেনে নিয়েছিলো, সোমনাথের বন্ধুত্ই চেয়েছিলো তারপর থেকে ।
কিন্তু সোমনাথের মধ্যে যে কি দারুণ একটা পরিবর্তন এসে গিয়েছিলো, তা বিনায়ক বা বাসবী কেউই ঘূর্ণাক্ষরে
টের পায়নি। সেই রাত থেকে সোমনাথের বুকের মধ্যে জুলছে এক হিংস্র অতৃপ্তি। তার নীতিবোধ যা মানতে
পারে না, তার যুক্তিহীন মন সেটাই তীব্রভাবে চায় । বাসবীকে যখন-তখন বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তবু
সোমনাথ খুব সাবধানে দূরত রক্ষা করে, ওদের বাড়িতে আর রাতে থাকেনি একদিনও ।
কলকাতায় ফিরে এসে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেল। দু'জনের বাড়ি দু'পাড়ায়, পেশা নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়লো দুই
ডাক্তার । তবু কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে বা ক্লাবে বাসবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই সোমনাথের বুক জুলে।
দাউ দাউ করে সেই অতৃত্তি। বাসবী তাকে চেয়েছিলো, সোমনাথ সাহস পায়নি। এটা তার নীতিবোধ না
কাপরুষতা । সেই রাতে বাসবীকে গ্রহণ করলে কি এমন ক্ষতি হতো?
এ সবই সোমনাথের মনে মনে । বাসবীর সঙ্গে সে হেসে হেসে কথা বলে, সব সময় খানিকটা দূরত্ব রাখে ।
ভদ্রতার সম্পর্ক যেমন রাখা উচিত, তা ঠিকই বজায় আছে। সোমনাথের স্ত্রী'র সঙ্গেও ভাব আছে বাসবীর।
শুধু এক এক সময় সোমনাথের খটকা লাগে । বাসবী হঠাৎ হঠাৎ কথা থামিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকে
সোমনাথের দিকে । তার ঠোটে তখন লেগে থাকে একটা অদ্ভুত ধরনের হাসি। বাসবী কি সোমনাথের ভেতরটা
দেখতে পায়?
তারপর সরকারের উৎকট খেয়ালে সোমনাথ আর বিনায়ককে এক সঙ্গে বাঁকুড়ায় বদলি হতে হলো । দু'জনে
একই বাড়ি ভাড়া নেবে, এটাই স্বাভাবিক। এখানেও সোমনাথ তার স্ত্রীকে আনতে পারেনি, বাস্তব অসুবিধে
আছে। সারা সপ্তাহ সে এখানে থাকে না।
আবার বাসবীর এই সান্িধ্য তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সর্বক্ষণ সেই আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে
হচ্ছে তাকে । এত বড় বাড়ি, কোনো এক সময় বাসবীকে নিভৃতে পাওয়া যেতেই পারে । বিনায়ক অনেক সময়
থাকে না। তবু সোমনাথ একবারও বাসবীকে ডাকার ইঙ্গিত দেয়নি। সে জানে, বাসবীর চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারে, বাসবীকে ডাকলেই সে আসবে । সোমনাথ ডাকে না। প্রাণপণে তাকে জদ্রতার সম্পর্ক রেখে
যেতেই হবে।
আজ রাতে বাসবী নিজে থেকে এসেছে। বিনায়ক নেই, বৃষ্টির শব্দমাখা মোহময় রাত।
বাসবীর পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সোমনাথ আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারলো না। তার ভেতরে
যেন একটা বিস্ফোরণ হলো। চেয়ার ছেড়ে ওঠে গিয়ে সে বাসবীর কীধে হাত রাখলো।
বাসবী চমকালো না। সে যেন এর প্রতিক্ষাতেই ছিলো । মৃদু গলায় বললো, সেই গানটা শোনাবে না, সোমনাথ?
সোমনাথ গুণগুণ করে শুরু করলো, স্বপ্নে আমার মনে হলো, তুমি ঘা দিলে আমার দ্বারে হায় ...।
দু'লাইন গাইবার পর থেমে গিয়ে সোমনাথ বললো, সত্যি আমি দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখেছি, তুমি আমর দরজা
ঠেলে আসবে একদিন ।
বাসবী বললো, ওটা তোমার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন ...
সোমনাথ বললো, তুমি কি জানো, তোমাকে ভীষণ ভীষণ আদর করতে ইচ্ছা করে আমার।
বাসবী বললো, কি তুমি জানো তোমাকেই আমি প্রথম ভালো বেসেছি। সে কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি
না।
সোমনাথ বললো, কিন্তু আমাদের দু'জনের যে দুটো সংসার আছে। ছেলেমেয়ে আছে, এখন কি এই সংসার
ভাঙ্গা যায়ঃ
বাসবী বললো, সংসার ভাঙার কথা কে বলেছে? তুমি বড্ড মরালিষ্ট, সোমনাথ । আমরা গোপনে দু'জনে
দু'জনকে ভালো বাসতে পারি না?
সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার কাছে আজ রাত্তিরে থাকবে?
বাসবী ফিরে দীড়ালো। তার ঠোট দু'টিতে ঝকঝক করছে বাসনা । তার সারা শরীর প্রস্তুত । তুচ্ছ নীতিবোধের
জন্য সে জীবনের আনন্দ নষ্ট করতে চায় না। গোপনীয়তাকে সে পাপ মনে করে না। সোমনাথ বাসবীর কোমরে
একটা হাত দিয়েছে, আর একটা হাত ওর বুকের সামনে উদ্যত ।
এই সময় সে শুনলো কয়েকবার কাশির শব্দ।
একতলায় চট-ফট পেতে খোলা বারান্দায় শুয়ে আছে সেই ছেলেটা । এতো জোর কাশছে যে এই তিন তলাতেও
শোনা যাচ্ছে। সোমনাথের অভিজ্ঞ কান সেই শব্দ শুনেই বুঝতে পারলো, ছেলেটা বাঁচবে না।
এখন কি এই সব কথা চিন্তা করার সময়? কতো গরীব লোকই তো মরছে।
সোমনাথের ক্ষণিক অন্যমনক্কতা বাসবীর নজর এড়ালো না। সে জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছো?
সোমনাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আ্যা? ভাবছি, একবার শুরু করলে কি আর থামতে পারবো?
বাসবী তার বুকের কাছ থেকে সোমনাথের হাতটা সরিয়ে দিলো । মুচকি হেসে বললো, তোমার হাতটা ঠাণ্ডা ।
তুমি আসলে ভাবছো, তোমার বন্ধুর কথা । কিংবা তোমার স্ত্রীর কথা । মিডল ক্লাস বাঙালী মরালিটি তুমি ছাড়তে
পারবে না।
সোমনাথের থুতনিতে একটা টোকা মেরে মেরে সরে গেল বাসবী। সে রাগ করেনি। বরং হেসেই আবার
বললো, থাক এভাবে হবে না। ভালোবাসার দরকার নেই, বন্ধুতুই ভালো । আজ চব্বশে জুলাই, ১৯৯২,
আজকের দিনটা মনে থাকবে, আজ আমি আমার সব ভালোবাসা তোমাকে দিয়ে গেলাম । এরপর দেখো, আমরা
শুধুই বন্ধু থাকবো ।
সকাল বেলা সোমনাথ নিচে নেমে এসে দেখলো, আলতাফ তার আগেই চলে গেছে। সাইকেল রিকশাটাই
নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে শেষ রাতে, এখন চতুর্দিকে একটা পরিচ্ছন্ন ভাব।
বাড়ির সামনের কম্পাউন্ডে টাটকা বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে সোমনাথ ভাবলো, এ আলতাফ নামের ছেলেটা
যতবার সাইকেল রিকশার প্যাডেল ঘোরাবে ঠিক ততবারই তিল তিল করে ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। ও
যদি বাচতে না চায়, কে বাঁচাবে ওকে । কেউ না। এ দেশে কোনো রোগীকে কি জোর করে হাসপাতালে ভর্তি
করার ব্যবস্থা আছে?
এই সময় একট গাড়ি এসে থামলো গেটের সামনে । বিনায়ক ফিরে এসেছে।
বিনায়ককে দেখে অদ্ভুত আনন্দ হলো সোমনাথের ।
কাল রাতে বাসবী চলে যাবার পর সে কিছুক্ষণ বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেদেছে। সে কথা কেউ
জানবে না। সে হেরে গেল বাসবীর কাছে। নিজের কাছেও।
কিন্তু কাল যদি সে বাসবীর সঙ্গে মিলিত হতো, তা হলে আজ সকালে বিনায়ককে দেখে কি সে স্বাভাবিক
থাকতে পারতো? একটা চোর-চোর ভাব হতো না? বিনায়ক যে নিশ্চিন্ত বাইরে রাত কাটিয়ে এলো, তার কারণ
সে তার বন্ধুকে বিশ্বাস করে।
সোমনাথের মনে এখন কোনো গ্রানি নেই।
সে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, কিরে রাত্তিরে ফিরতে পারলি নাঃ
বিনায়ক বললো, আর বলিস না। এক ব্যাটা জোতদার, জমি টমি নিয়ে কি সব গন্ডগোলে তার এক কাকা তার
পেটেগুলি চালিয়ে দিয়েছে।
লোকটা আগে একবার কিডনির চিকিৎসা করিয়েছে আমার কাছে। গুলি খেয়ে সে কিছুতেই হাসপাতালে যাবে
না, খালি আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে বলছিল, এঁ ডাক্তার বাবু না এলে আমি বাচবো না । তাই ওর ছেলেরা আমাকে
জোর করে ধরে নিয়ে গেল।
_বেঁচেছে?
_বেঁচে যাবে । গুলিটা বার করে দিয়েছে। জ্ঞান ফেরার পরই সে চ্টাচাতে লাগলো, সে তার কাকাকে তক্ষুণি
খুন করতে যাবে । গ্রামের লোকের যা সব ব্যাপার
-এ তো কেস হবে।
হ্যা পুলিশের এক দারোগা অপারেশনের সময় আমার পাশে বসে ছিল। তুই চা খেয়েছিস?
_না এখনো খাইনি।
_বাসবীর ঘুম ভেঙেছে?
-কী জানি দেখিনি।
-চল ওকে ডেকে তুলি । আমার সঙ্গে চা খেয়ে যা।
দুই বন্ধু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো পাশাপাশি ।
বাসবী জেগে উঠেছে এর মধ্যেই । ছোট বাচ্চা থাকলে সেই মা বেশিক্ষণ ঘৃমাতে পারে না।
এখন বাসবী শাড়ি পরা, চুলে একটা আন্না খোপা বাধা, এখন তার চেহারা বেশ স্বাভাবিক, ঘরোয়া । সুন্দর
দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে নেই মাদকতা । ঠোটের চকচকে ভাবটাও নেই।
সোমনাথকে দেখেই সে বকুনির সুরে বললো, কী যে করো তুমি। একটা রোগীকে নিচে শুইয়ে রেখেছিলে ।
সারা রাত সে এত কেশেছে যে সেই শব্দে আমি ঘুমুতেই পারিনি ।
বিনায়ক চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার?
সোমনাথ বললো, ও একটা রিকশাওয়ালা । গায়ে খুব জুর ছিল, বৃষ্টির জন্য আর ফিরতে পারেনি ।
বাসবী বললো, বাড়িতে তুমি রোগী নিয়ে আসবে, তার জন্য আমরা ঘুমোতে পারবো না।
সোমনাথ বললো সরি! আর কারুকে আনবো না।
বিনায়ক প্রসঙ্গটাকে গুরুত্ না দিয়ে বললো, বাসবী চা চাপাও। তুমি ছৌ নাচের মুখোশ কিনতে চেয়েছিলে,
তোমার জন্য অর্ডার দিয়ে এসেছি।
সোমনাথ বাসবীর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে । সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তার বুকের মধ্যে সেই
বাসনার আগুনটা প্রায় নিভু-নিভূ, এখন শুধু ধোয়া বেরুচ্ছে একটু একটু । বাসবী আর কোনো দিন তেমনভাবে
আসবে না।
বিনায়ক বললো, আমাকে দশ হাজার টাকা ফি দিল, জানিস। গ্রামের এই সব জোতদার-ফোতদারদের কিন্তু
অনেক টাকা।
বাসবী বললো, চলো এবারের ছুটিতে আমরা ভুটান যাই। বিনায়ক বললো, দীড়াও এখানে প্র্যাকটিস বেশ
ভালো জমে উঠেছে। এক্ষুণি ছুটি নেওয়া যাবে না।
চা খেয়ে সোমনাথ ওপরে ওঠে এলো । সে এখনো কলকাতায় চেম্বার রেখেছে, এখানে প্র্যাকটিস করে না।
দুপুরে ভাত খায় না সোমনাথ । বেকফাষ্ট খেয়ে মেডিক্যাল কলেজে যায়। ক্লাস সেরে হাসপাতালে রাউন্ড দেয় ।
আজ সন্ধ্যা বেলা সে কলকাতায় ফিরে যাবে ।
এক একটা ক্লাস শেষ হতেই সে একবার করে হাসপাতালের গেটের কাছে এসে উকি দিয়ে দেখে যেতে
লাগলো । তৃতীয় বার এসে সে পেয়ে গেল আলতাফ মন্ডলকে ।
সাইকেল রিকশার যাত্রীদের সিটের ওপর সে কাৎ হয়ে বসে আছে । আজ তার বেশ জুর। মুখ দেখলেই বোঝা
যায়।
কাছে গিয়ে সোমনাথ বললো, এই, নেমে আয়। সকাল বেলা আমার কিছু না বলে চলে গেলি যে?
আলতাফ খুব ভয় পেয়ে বললো, আপনার ঘুম ভাঙাইনি, স্যার তাছাড়া বাড়ির লোক খুব চিন্তা করবে।
_নেমে আয়।
সোমনাথ ওকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বুকের এক্সরে তোলালো । রক্ত ও থুথু পরীক্ষার জন্য নিল। তারপর ওকে সামনে
আলতাফ বললো, না স্যার। মালিকের । রোজ দশ টাকা করে দিতে হয়।
_ভাড়া মিলুক না মিলুক, তবু দশ টাকা দিতেই হবে?
হ্যা স্যার । দশ টাকার ওপরে যা পাবো, সেটা আমার।
_সাধারণত কত থাকে তোর?
-পনেরো টাকা । এক একদিন একটু কমে যায়।
-তুই আর রিকশা চালাতে পারবি না। এমনকি আজ এঁ রিকশা চালিয়ে বাড়িতেও ফিরতে পারবি না। গাড়ি
জমা দিয়ে দিতে হবে। বাড়িতে গিয়ে টানা এক মাস শুয়ে থাকবি।
স্যার । কিন্তু রিকশা না চালালে আমার বাড়ির লোক খাবে কি?
-তোর বাড়ির লোক কি খাবে, তার আমি কি জানি?
তুই একটা রোগী, আমি তোর চিকিৎসা করবো । তোর বাড়ির লোক কি খাবে না খাবে, তা আমি চিন্তা করতে
যাবো কেন? আমার কথা যদি না শুনিস, পুলিশে খবর দেবো । তুই তো টিবি রোগে মরবিই, আরও কত লোকের
মধ্যে এই রোগ ছড়াবি। পুলিশ তোকে জেলে ভরে রাখবে ।
সোমনাথ জানে, এটা নিতান্তই মিথ্যে ভয় দেখানো । টিবি রোগীকে নিয়ে পুলিশের মাথাব্যথা নেই । রাস্তার কত
ভিখিরিরও তো এই রোগ আছে।
এখানকার হাসপাতালেও আলতাফকে ভর্তি করা যাবে না। এই হাসপাতালে টিবি রোগী রাখার ব্যবস্থা নেই।
মেদিনীপুরের ডিগ্রী হাসপাতালে পাঠানো যেতে পারে, অথবা কীচড়াপাড়ায়। সেখানেও সিট আছে কি না
জানতে হবে আগে । অচেনা, দূরের হাসপাতালে ছেলেটা যেতে চাইবে কি না, তাতেও সন্দেহ আছে।
সোমনাথ বললো, এক্সরেটা ঠিক উঠেছে কি না দেখে নিক, তারপর তোকে বাড়ী পাঠিয়ে দেবো। কিছু
ওষুধপত্রও দিয়ে দিচ্ছি, নিয়মিত খাবি। একজন ছাত্রের সঙ্গে ব্যবস্থা করছি, সে তোকে ইঞ্জেকশন দিয়ে আসবে
কয়েকদিন।
তারপর পকেট থেকে পার্সটা বার করে তিনটে একশো টাকার নোট বার করে বললো, এই তোর এক মাসের
রোজগার । তা বলে ভাবিস না, আমি তোকে মাসে মাসে টাকা দেবো । আর কখনো এক পয়সাও দেবো না।
আমি হয়তো বেশি দিন এখানে থাকবোও না। তোকে নিজের চেষ্টায় বাচতে হবে। নিচে নেমে এসে আর
একজন রিকশা চালকের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে দিল সোমনাথ । সে আলতাফের গাড়িটা জমা করে দেবে, তারপর
তাকে পৌঁছে দেবে তার গ্রমের বাড়িতে । তার জন্য সে পয়সা পাবে অবশ্য ।
শেষবারের মতন আলতাফকে সে শাসিয়ে বললো, এক মাস একেবারে চুপ করে শুয়ে থাকবি। বেশি হাটা চলা
করবি না। কক্ষনো দৌড়েবি না। ভারী জিনিস তুলবি না। মনে থাকবে? যদি শুনতে পাই তুই রিকশা চালাচ্ছিস,
তা হলে পুলিশে ধরিয়ে দেবো ।
সোমনাথ লক্ষ করেনি, আলতাফকে ও অন্য রিকশা চালকটিকে যখন সে এই সব কথা বলছে, তখন তার পাশে
এসে দীড়িয়েছে এক মাঝ বয়েসী জ্দ্রলোক। ধুতি-পার্জাবি পড়া সৌম্য চেহারা, এর নাম বীরেশ্বর ঘোষ ।
এখানকার একটি স্কুলের হেড মাস্টার এবং যে ক্লাসে সোমনাথ মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে যায় সেখানকার ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সোমনাথ মুখ ফেরাতেই বীরেশ্বর বললেন, নমস্কার । কী ব্যাপার বলুন তো। একটা রিকশাওয়ালাকে জামাই
আদরে আর একটা রিকশায় চাপালেন, তারপর আবার তাকে ধমকালেন।
সোমনাথ একটু লঙ্জা পেয়ে গেল। তার মেজাজটা ঠিক নেই, সে একটু বেশী জোরে জোরে কথা বলে থেমেছে।
একটা নিবন্ত আগুন যে এখনো একটু একটু ধোয়াচ্ছে তার বুকের মধ্যে ।
সে বললো মাস্টার মশাই, আমার সঙ্গে একটু হাটবেন? আমি বাড়ির দিকে যাবো । যেতে যেতে আপনাকে
কয়েকটা প্রশ্ন করবো ।
বীরেশ্বর বললেন, আমি তো হেঁটে হেঁটেই ঘুরি সব সময় । রিকশা চড়ি না। বলুন আপনার প্রথম প্রশ্নঃ
সোমনাথ বললো, প্রশ্নগুলো আসলে সামাজিক প্রশ্ন । ধরুন, আমি একজন ডাক্তার । আমি যদি একজন লোককে
দেখে বুঝতে পারি, সে একজন রোগী, তা হরে তার চিকিৎসা তো করতেই হবে ।
-সেই রোগী আপনাকে কল না দিলেও আপনি চিকিৎসা করবেন?
ধরুন, রাস্তার একটা লোককে দেখলাম । তখন তো কল দেবার প্রশ্ন নেই।
-আপনার ফি কে দেবে?
ডাক্তারী পড়াবার সময় তো ফি নেবার কথা কিছু শেখায় না। অসুস্থ লোকদের সাহায্য করা বা বাচানো হচ্ছে
ডাক্তারদের কর্তব্য । আমাদের ফি নিতে হয়, কারণ আমাদেরও তো সংসার চালাতে হবে। এটাই আমাদের
জীবীকা।
_সে কি মশাই । আপনাদের মতন বড় বড় ডাক্তারদের ডেকে ডেকেও পাওয়া যায় না। ফি না নিয়ে চিকিৎসা
করে আবার কোন ডাক্তার? এ রকম তো কখনো শুনিনি । আজকাল এক রোগীকে তিন-চার বার দেখলে প্রত্যেক
বারই ডাক্তাররা সমান টাকা নেন। আগে দ্বিতীয় বার থেকে ফি অর্ধেক হয়ে যেতো ।
-আহা, মাস্টারমশাই, কথাটা অন্য দিকে ঘোরাবেন না। আমি যা বলছি, তা নীতির প্রশ্ন । পরিবারের খাওয়া
দাওয়ার ব্যবস্থাও কি ডাক্তারকে করে দিতে হবে?
-ঠিক বৃঝলুম না। আর একটু খোলসা করে বলুন ।
_ধরুন, এই যে একজন সাইকেল রিকশা চালক । ওর সাংঘাতিক টিবি হয়েছে। আমি চিকিৎসা করে ওকে
বাচাবার চেষ্টা করতে পারি । কিন্তু এই রোগ নিয়েও রিকশা না চালালে ওর খাওয়া জুটবে না, ওর বাড়ির লোকও
না খেয়ে মরবে। অথচ টিবি রোগী যদি সাইকেল রিকশা চালায় দিনের পর দিন, তা হলে যে তার চিকিৎসার
কোনো মূল্য নেই, সেটা নিশ্চয়ই আপনি বোঝেন?
-সেই জন্যই ছেলেটাকে ধমকাচ্ছিলেন?
_ডাক্তারেরও তো বিবেক আছে। সে তার বিবেককে কী বোঝাবে?
-এত রোগী ঘাটাঘাটি করতে হয়। তারপরেও ডাক্তারের বিবেক টিকে থাকা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার । রাস্তায়
-এই জন্যই তাকায় না, যে সেই ভিখিরির শুধু চিকিৎসা করলেই হবে না, তার খাওয়া থাকা সব কিছুর দায়িতৃুই
ডাক্তারকে নিতে হবে । এটা কি ডাক্তারের কাজ, না সমাজ কিংবা সরকারের কাজ?
-সবই তো জানি । আপনাকে একটু খোচাচ্ছিলাম, ডাক্তার সাহেব। এ আলতাফ নামের ছেলেটাকে আমি চিনি ।
এক সময় আমার মেয়েকে রোজ স্কুলে পৌছে দিত । ও নিজে ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়েছে। ওর বাবা মারা
গেল, সংসারে আর রোজগার করার কেউ নেই । খাটতে খাটতে ছেলেটার মুখে রক্ত উঠে গেলে ।
-ও তো মরবেই। বীজাণু ছড়িয়ে ছড়িয়ে আরও অনেককে মারবে ।
-আপনি নিজে থেকে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থ করলেন। এবার আমাদেরও কিছু একটা করা উচিত। ভেবে দেখি,
কী করা যায়।
-যদিও ওকে অন্য একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়েছে, কী-ই-বা চাকরি
পাবে? যাতে শারীরিক পরিশ্রম নেই।
-একটা ব্যবস্থা হতে পারে । আমাদের স্কুলে একটা দফতরির পোস্ট খালি হয়েছে। সেটা যদি ওকে দেওয়া যায়।
বসে বসে ঘন্টা বাজাবে, ক্লাসে ক্লাসে ্যাটেন্ডেস রেজিক্ট্রার পৌছে দেবে, মোটামুটি হালকা কাজ । সে কাজ ও পেরে যাবে । সোমনাথ থমকে দীড়িয়ে পড়লো ।
বীরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললো, এ তো খুব ভালো প্রস্তাব। আপনি হেড মাস্টার, আপনি অনায়াসে ওকে এই
কাজটা দিতে পারেন।
বীরেশ্বর বললেন, স্কুল কমিটিকে বলতে হবে । মনে হয়, আটকাবে না।
-কত মাইনে?
-শ" পাচেকের মতন পাবে । দেখি চেষ্টা করে যদি আরও পঞ্ঝাশ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আমাদের স্কুলের
মাইনেপত্র ভালোই ।
_মাস্টার মশাই, এ যে প্রায় অলৌকিক ব্যাপার । আমি ভেবেছিলাম, ও ছেলেটার কোনো আশা নেই। সপরিবারে
মারা যাবে । আজই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি আজ সন্ধ্যোবেলা কলকাতা যাচ্ছি। তিন দিন পর
ফিরবো । তখন আপনাকে এসব বলার কথা আমার হয়তো মনেই পড়তো না। ছেলেটার তাহলে একটা হিল্লে
হয়ে গেল?
বীরেশ্বর একগাল হেসে বললেন, তা হলে কী প্রমাণ হলো?
ডাক্তার বাবুদেরও রোগীদের চাকরি-বাকরি নিয়ে ভাবতে হয়।
বেশ খুশি মনে শিষ দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো সোমনাথ ।
তার হাতে আধ ঘন্টা সময় আছে। মুখ হাত ধুয়ে, হাসপাতালে পোশাক বদলে নিতে হবে। পাঁচটার সময়
শেয়ারের ট্যাক্সি ছাড়ে দুর্গাপুরে যাবার জন্য । ঠিক কলকাতার ট্রেন ধরিয়ে দেয়।
ট্রেনে পড়ার জন্য একটা বই নিতে হয়। সোমনাথ বই বাছতে লাগলো ।
রাম এসে বললো, দোতলার বউদিদি আপনাকে একবার দেখা করে যেতে বলেছেন।
সোমনাথ অবাক হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো।
বিনায়ক এ সময়ে বাড়ি থাকে না। বাচ্চাটা আয়ার সঙ্গে এই সময় বেড়াতে যায়। বাসবী একা । তবু সে ডেকে
পাঠাবে কেন? কাল রাতের পর, আবার এই আহ্বান যেন মেলে না।
তব্ যেতেই হবে।
কলকাতায় যাবার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো সোমনাথ । আজ তার বুক টিপ টিপ
করছে না, শুধু সুক্ষ ব্যথার অনুভূতি রয়ে গেছে।
দরজায় বেল দিতে বাসবীই খুললো । কাজের লোক-টোক কেউ নেই।
বাসবী বললো, এসো-
কাল রাতের মতন মোহময়ী নয়, আজ সকালের মতন নিছক ঘরোয়াও নয়, বাসবী বেশ সেজে আছে। একটা
নীল কাজ করা টাঙ্গাইল শাড়ি পরেছে, নীল পাথর বসানো কানের দুল দুটি সকালে ছিল না, গলায় একটা মটর-
দানার মতন হার।
কিন্তু তার মুখে কোনো রহস্য নেই, একেবারে পরিষ্কার ।
দরজাটা খোলাই রইলো, সোমনাথ ভেতরে এসে বসলো একটা
বেতের চেয়ারে ।
বাসবী বললো, তুমি, তুমি তো আজ কলকাতায় যাচ্ছো । পৌছতে পৌছতে অনেক রাত হয়ে যাবে । খিদে পাবে
না?
এ আবার কী প্রশ্নঃ খাওয়াটা আবার সমস্যা নাকি? দুর্গাপুর পৌছে কিছু খেয়ে নিলেই তো হয়। ট্রেনের
কামরাতেও নানা রকম ফেরিওয়ালা আসে । সোমনাথ এখনো চলন্ত ট্রেনে বসে বাদাম ভাজা ছাড়িয়ে খেতে
ভালবাসে ।
বাসবী বললো, আজ একটা বড় ভেটকি মাছ দিয়ে গেল ওর এক পেসেন্ট।
অত বড় মাছ কে খাবে? তাই ফিস কেক বানিয়েছি। কেমন হয়েছে জানি না। তোমাকে খেতে হবে। তোমার
ওপরেই প্রথম এক্সপেরিমেন্ট করবো ।
লন্ডনে যখন প্রথম আলাপ হয়, তখন বাসবী একেবারেই রান্না জানতো না, ও থাকতো হস্টেলে। বিনায়ক আর
সোমনাথের নিজন্ব আ্যাপার্টমেন্ট ছিল, ওরা রান্না শিখে নিয়েছিল । বিনায়ক বেশ ভালোই রাধতো ।
বিয়ের পরেও বাসবীর কখনো রান্নার দিকে ঝৌক দেখা যায়নি। এখানে ওদের রান্নার লোক আছে। বাসবী
রান্নাঘরে যাওয়াটা পছন্দ করে না।
সোমনাথ বললো, তুমি ফিস কেক তৈরি করেছো?
বাসবী হেসে ফেলে বললো, কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? একটা রান্নার বই দেখে শিখলাম ।
সোমনাথ তবু অবিশ্বাসের সুরে বললো, ফিস কেক? কখনো খাইনি ।
_খেয়ে দ্যাখো ।
একটা কাট গ্রাসের সুদৃশ্য প্রেটে খানিকটা সাদা রঙের কেকের মতন জিনিসই নিয়ে এলো বাসবী। সঙ্গের কীটা-
চামচ রুপোর । ওদের রুপোর ডিনার সেট আছে, সোমনাথ জানে, কোন দিন বার করে না।
বাসবী বললো, প্রথমে একটু খানি মুখে দিয়ে দ্যাখো । যদি ভালো না লাগে, খেও না। জোর করে খেতে হবে
না।
সোমনাথ একটা বড় টুকরোই কেটে নিয়ে মুখে দিল । কোনো বিশ্রী গন্ধ নেই। মাছের গন্ধই নেই প্রায়, কিন্তু
মাছের স্বাদ আছে, পুড়ে যায়নি, নুন বেশি হয়নি।
মুখ তুলে সোমনাথ বললো বাঃ। বেশ ভালো হয়েছে তো?
-সত্যি বলছো? আমি তোমার অনেস্ট ওপিনিয়ান চাইছি।
আমার মন রাখা কথা বলতে হবে না।
_সত্যি ভালো লাগছে। নতুন ধরনের জিনিস । এই দ্যাখো, সবটা খেয়ে নিচ্ছি। জানো তো, যে খাবারের টেস্ট
আমর ভালোলাগে না, সেটা আমি কিছুতেই খেতে পারি না।
-শখ করে তৈরি করেছি। তাই ইচ্ছে হলো, তোমাকেই প্রথম পরিবেশন করবো ।
_হঠাৎ রান্নার শখ হলো কেন, তোমার?
-একটা কিছু তো করতে হবে। পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী ছিলাম, সে পড়াশুনো কোনোই কাজে লাগলো না।
এখন শুধুই হাউজ ওয়াইফ । আর হাউজ ওয়াইফই হয়ে যদি থাকতে হয়, তা হলে ভাল করে হওয়াই ভালো ।
রান্নাবান্না, সেলাই, ছেলে মানুষ করা, ঘর সাজানো-_
-তুমি নতুন নতুন রান্না করলে ভালোই হবে । আমরা মুখের স্বাদ বদলাতে পারবো ।
-সময় কাটাতে হবে তো। দুপুরে ঘুমোনোর বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে। এরপর মোটা হয়ে না যাই।
-তোমার ফিগার খুব ভালো আছে ।
_বিকেলের পর থেকে আর সময় কাটে না। তোমার বন্ধু চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । তোমার বেশ মজা,
এখন তিন দিন কলকাতায় কাটিয়ে আসবে।
-তোমরা ইচ্ছে করলে মাঝে মাঝে শনিবার বিকেলে কলকাতায় গিয়ে সোমবার সকালে ফিরে আসতে পারো ।
_-বিনায়ক কলকাতায় যেতেই চায় না। ওর তো থিয়েটার কিংবা সিনেমা দেখারও বঝৌঁক নেই। আমার খুব
থিয়েটার দেখতে ইচ্ছে করে । তুমি ঘড়ি দেখছো কেন? বসো, চা করছি।
সোমনাথ সত্যিই একবার চোরা-চোখে ঘড়ি দেখেছে । আর দেরি করলে পাচটার শেয়ারের ট্যাক্সি পাওয়া যাবে
না। এরপর অবশ্য সে একলাপুরো ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি নিতে পারে । টাকা বেশি খরচ হবে, কিন্তু সে কথাটা
বলা যায় না বাসবীকে।
সে উৎসাহ দেখিয়ে বললো, হ্যা চা-তো খেতেই হবে। বাসবী জিজ্ঞেস করলো, আর একটু ফিস কেক নেবে?
-আপত্তিত নেই। কিন্তু এতটা খেয়ে ফেললে কি তোমাদের জন্য আর থাকবে কিছু?
-আরও অনেক আছে। মাছটা মস্ত বড় ছিল। ফ্রিজে রেখে তিন চারদিন খাওয়া যাবে। হ্যা, ভালো কথা, তুমি
কলকাতা থেকে ফেরার সময় বড় বাজার থেকে ভালো হিং কিনে আনতে পারবে আমার জন্যঃ এখানে ভালো
হিং পাওয়া যায় না। একটা রান্নার রেসিপি দেখলাম, হিং দিয়ে চিকেন, সেটা একবার করে দেখতে চাই।
-ঠক আছে। নিয়ে আসবো । আর কিছু অর্ডার আছে? বাসবী আবার হাসতে লাগলো ।
হাসি-ছাড়নো মুখে বলে মফঃস্বলের মানুষ এরকম হয়, তাই না? কেউ শহরে গেলে অমনি এটা-সেটা আনতে
দেয়।
চা খাওয়াও শেষ হলো । আর দেরি করা যায় না। এরপর আর দুর্গাপুর থেকেও ট্রেন ধরা যাবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন