বাসবী গল্প করার মেজাজে আছে। সোমনাথ তবু উঠে দীড়ালো। বাসবী আপত্তি করলো না | সে বললো হ্যা,
এবার তোমার যাওয়া দরকার । দরজার কাছে এসে সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, তুমি এত সাজগোজ করে আছে
কেন? কোথাও বেরুবে বুঝি?
বাসবী বললো, না এখানে আর কোথায় যাওয়ার আছে?
বাড়িতেই থাকবো । এক একদিন নিজের জন্যই সাজতে ইচ্ছে করে। একটু সাজগোজ করলে, পারফিউম
মাখলে মনটা ভালো থাকে।
বাড়ির বাইরে এসে সোমনাথ একটা রিকশার জন্য এদিক ওদিক তাকালো । একটাও দেখা যাচ্ছে না। খুব
দরকারের সময় পাওয়া যায় না কিছুতেই । হেঁটেই যেতে হবে বাস স্ট্যান্ড ।
দ্রুত হাটতে লাগলো সোমনাথ । হঠাৎ সে বুঝতে পারলো, তার মুখটা তেতো হয়ে আছে।
খাবারটার জন্য নয়, ফিস কেক বেশ সুস্বাদু ছিল। কিন্তু, কাল রাতে বাসবী তার নিজের শরীরটা দিতে
চেয়েছিল, সোমনাথ নিতে পারেনি । আজ বাসবী তাকে মাছ খেতে দিল, সোমনাথ দিব্যি খেয়ে নিল। এর মধ্যে
কি বাসবীর একটা সৃক্ষ বিদ্রুপ আছে? মনে মনে হাসছিল?
বাসবী আজ নিখুঁত ফর্মাল ব্যবহার করলো । যেন সে শুধুই তার বন্ধুর স্ত্রী, আর কিছু নয়। পুরোটাই কি ওর
অভিনয়?
আজ চলে আসার আগে বাসবীকে অন্তত একটা চুমুও কি খেতে পারতো না সোমনাথ? একটা চুমু, কয়েক
নিমেষের আনন্দ। তাতে সারা পৃথিবীর কারুর কোনো ক্ষতি হতো না।
চুমু খেতে চাইলে কি আপত্তি করতো বাসবী? ইচ্ছে প্রকাশ করারই তো সাহস হলো না সোমনাথের ।
বাসবীর কাছে সে বার বার হেরে যাচ্ছে।
এরপর ন' বছর কেটে গেছে।
বাকুড়া থেকে আর ছ'মাসের মধ্যেই আবার ট্রান্সফার হয়ে ফিরে এসেছিল সোমনাথ । বিনায়করা দেড় বছর পর।
বাকুড়ায় আর কোনদিনই যায়নি সোমনাথ, প্রয়োজন হয়নি, উপলক্ষ আসেনি ।
কলকাতায় এখন সে বেশ ব্যস্ত ডাক্তার । নাম শুনলেই অনেকে চেনে । বিনায়ক আরও বেশি ব্যস্ত, আরও বেশি
খ্যাতিমান । সম্টলেকে মস্ত বড় বাড়ি বানিয়েছে বিনায়ক, সোমনাথ গলফ, গ্রীনে ফ্ল্যাট কিনেছে । দু'জনে থাকে
শহরের দুই প্রান্তে ।
বাসবীর জন্য যে আগুন জুলতো সোমনাথের বুকে তা নিভে গেছে কবে, ধোঁয়া-টোয়াও আর বেরোয় না। ব্যথার
বোধ নেই, সময়ই পায় না ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবার।
বিনায়কের সঙ্গে সোমনাথের মাঝে মাঝে কোনো কোনো নার্সিং হোমে দেখা হয়ে যায়, অনেক সময় একই
রোগীকে দু'জনেই দেখতে আসে, দুই বন্ধু কিছুক্ষণ গল্প হয়। বাসবীর সঙ্গে সোমনাথের দেখা হবার সুযোগ
প্রায় নেই, সামাজিকভাবে মেলামেশা আর হয়ই না বলতে গেলে । বিনায়কদের সল্টলেকের বাড়ি তৈরি হবার
পর বিরাট পার্টি দিয়েছিল ওরা । সেদিন বাসবী খুব ব্যস্ত ছিল। সোমনাথের সঙ্গে দুটো একটার বেশি কথা বলার
সময়ই পায়নি । সোমনাথের চেয়ে বরং তার স্ত্রী শান্তার সঙ্গেই গল্প হয়েছে বেশি ।
আর একদিন দেখা হয়েছিল ক্যালকাটা ক্লাবে । সেদিন মনে হয়েছিল যেন বাসবীর মুখখানা একটা সাদা পৃষ্ঠার
মতন। সোমনাথের দিকে তাকাচ্ছে, অথচ তার দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই। সোমনাথকে কি সে মন থেকে
একেবারেই মুছে ফেলেছে। অথবা সে সোমনাথকে ঘৃণা করে? তাকে আর পুরুষ বলেই গ্রাহ্য করে না। সকলেই
বলে বিনায়ক পরিশ্রম করছে বড় বেশি। টাকা উপার্জনের নেশায় সে উন্যত্ত। ছুটি নেয় না। কোথাও বেড়াতে
যায় না। এর জন্য অবশ্য তাকে দু”টি ধাক্কা খেতে হলো ।
একবার ছোটখাটো একটা হার্ট আযাটাক হয়ে গেলে বিনায়কের। বন্ধুরা সবাই তাকে দেখতে গেল নার্সিং হোমে ।
সোমনাথও গিয়েছিল। সেদিন বাসবীর সঙ্গে তার দেখা হয়নি, বাসবী একটু আগে চলে গেছে। নার্সিং হোম
থেকে । বিনায়কের অবশ্য গুরুতর কিছু হয়নি, মাসখানেক বাদেই সে আবার প্র্যাক্টিস শুরু করে ছিল আগের
মতন।
তার কিছুদিন পরেই শোনা গেল, বাসবীর সঙ্গে বিনায়কের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
খবরটা শুনেই সোমনাথের মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই বাসবীর একজন প্রেমিক জুটেছে। নিছক হাউজ ওয়াইফ
সেজে থাকার মেয়ে সে নয়। তার নীতিবোধ আলাদা । গোপনে প্রেম করার ব্যাপারে তার কোনো দ্বিধা নেই।
ডিভোর্সের পর বাসবী আলাদা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রইলো, একটা চাকরিও পেয়ে গেল লেডি ব্রেবোর্ন
কলেজে । ওদের ছেলেটি দার্জিলিং-এ।
কিন্তু বাসবীর প্রেমিকটি কে, সেটাহি হলো অন্য ডাক্তারদের কৌতুহলের বিষয় । কিছুতেই তার সন্ধান পাওয়া
যাচ্ছে না। সে একা থাকে, এখন সে একটা গাড়ি কিনেছে, ড্রাইভার রাখেনি, নিজেই চালায়, কিন্তু তার গাড়িতে
অন্য কোনো পুরুষকেও দেখা যায় না কখনো । বিনায়কের বন্ধুদের বিশেষ কৌতুহল, বাসবীর প্রেমিকটি কোনো
ডাক্তার কি-না । একজন ডাক্তার হয়ে অন্য ডাক্তারের বউকে ভাণিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক এথিকাল নয় । অন্য
পেশার কোনো লোক হলে অস্বাভাবিক কিছু নয়, বাসবী এখনো দেখতে ভারি সুন্দর রয়েছে।
কিন্তু কোথায় বাসবীর সেই প্রেমিক?
সোমনাথ আর বিনায়ক... এই দু'জনেরই বন্ধু বিশ্বদেব, সেও নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট, সে বিনায়কদের
বাড়িতে প্রায়ই যায়। একদিন সেই বিশ্বদেব বেঙ্গল ক্লাবে লাঞ্চ খেতে খেতে অনেক ভেতরের কথা খুলে
বললো।
বিশ্বদের বললো, দ্যাখ সোমনাথ, আমাদের মুক্কিল কি জানিস, একটা সময় যখন আমরা সার্থকতার মুখ দেখি,
যখন বেশ নামডাক হয়, তখন একটা ট্র্যাজেডি ঘটে যায় । আমাদের ওপর, আমাদের সময়ের ওপর, আমাদের
নিজেদেরই কোনো কন্ট্রোল থাকে না। আমরা বউ বাচ্চাদের দিকে তো তাকাতে ভুলে যাই বটেই, এমনকি
নিজের দিকেও তাকাতে ভুলে যাই।
সোমনাথ বললো, সার্থকতা কাকে বলে? নিজের ব্যক্তিগত জীবনটাকে নষ্ট করে ফেলা? যারা এটা বোঝে না,
তারা নির্বোধ । মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখা খুব দরকার । আমি কোন দিকে চলেছি, আমি শেষ
পর্যন্ত কী চাই, সেটা ভাবতে হবে নাঃ
_যারা ভাবে না, তারাই তো ট্রাজেডির শিকার হয়। দ্যাখ, বিনায়কদের যে বিয়েটা ভেঙে গেল, তার জন্য আমরা
বাসবীকে দায়ী করেছি সবাই । আমরা পুরুষ মানুষ, তাই বিনায়কের পক্ষে । অনেকের ধারণা, বাসবী লুকিয়ে
লুকিয়ে কারুর সঙ্গে প্রেম করেছে। মোটেই তা নয়। আসল কারণটা আমি জানি ।
সেটা কী?
-ওদের দু'জনের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কই ছিল না অনেক দিন।
_সে কি, কেন? বিনায়কের কোনো প্রবলেম আছে?
_প্রবলেমটা শারীরিক নয়, মানসিক। বিনায়ক কোনো দিনই বাসবীর মনটা বুঝতে পারেনি, বোঝার চেষ্টাও
করেনি । বাসবী রোমান্টিক ধরনের মেয়ে। এ এক সময় নাচতো, গান বাজনা ভালোবাসে, নতুন কোনো
থিয়েটার হলে দেখতে যাবেই । বিনায়কের এ ব্যাপারে কোন রস-কষ নেই। বউয়ের জন্য সে সময়ই দিতে
পারে না। বউকে নিয়ে কোথাও যাবে, দু'দণ্ড বসে গল্প করবে, এমনকি ঝগড়াও করবে, তার সময় নেই? এরকম
করলে কী চলে?
-অত টাকা নিয়ে বিনায়ক কী করবে? একটা তো মোটে ছেলে।
-বিনায়কের ধারণা, ও তো এত খাটছে বউয়ের জন্যই । সে অতবড় বাড়ি করে দিয়েছে, বাসবী যত ইচ্ছে গয়না
গড়াতে পারে, মুঠো মুঠো টাকা খরচ করতে পরে.... কোনো কোনো মেয়ে এসবই ভালোবাসে, তাও সত্যি,
কিন্তু বাসবী যে অন্য টাইপ, সেটাই বিনায়ক বৃঝলো না। তার ফলটা কী হলো জানিস? বিনায়ক আমাকে নিজে
বলেছে, রাত্তির বেলা বিছানায় বাসবীকে কাছে টানলে বাসবী সাড়া দেয় না। ওর শরীরটা ঠান্ডা হয়ে থাকে।
স্বামীর সঙ্গে যদি একেবারেই মনের মিল না থাকে, তা হলে সেই স্থামীব্ত্রীর মধ্যে ঠিক মতন যৌন সম্পর্কও
হতে পারে না। বিনায়ক বলেছে, প্রায় ন-দশ বছর ধরে ওদের এই রকম চলছে। বাইরের লোকজনের সামনে
স্বামী-স্ত্রীর ঠাট বজায় রাখে, অথচ ভেতরে ভেতরে কোনো সম্পর্কই নেই। এরকম একটা মিথ্যে ব্যাপার শুধু
শুধু টিকিয়ে রাখার কী দরকার? সেই জন্যই তো বাসবী ডিভোর্স চাইতে বিনায়ক কোনো কনটেস্ট করেনি।
-তা হলে এর মধ্যে তৃতীয় পুরুষ কেউ নেই?
-তোকে খুব একটা গোপন কথা বলি, সোমনাথ । কারদকে জানাবি না। ওদের বাড়িতে তো আমি প্রায়ই যাই।
বাসবীর অবস্থাটা বুঝেছিলাম । বাসবীর ওপর আমার একটা দুর্বলতা জন্মে গিয়েছিল । আমি খানিকটা এগিয়েও
ছিলাম । কিন্তু বাসবীই থামিয়ে দিল।
-চুমু-টুমু পর্যন্ত এগিয়েছিলি?
-ধ্যাৎ শালা । চুমু পর্যন্ত এগোলে আর বাকিটা হতে দেরি লাগে নাকি? শুধু এর হাত ধরেছি একদিন। বাসবী
পরিষ্কার বলে দিল, বিশ্বদেব, তোমার সঙ্গে আমার ওসব কিছু হবে না। বিনায়কের কোনো বন্ধুর সঙ্গে প্রেম
করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সোমনাথের বুকের মধ্যে যেন কুলকুল করে একটা আনন্দের বর্ণা বয়ে যেতে লাগলো ।
বাসবীর যে আর কোনো প্রেমিক নেই, এটা যেন তারাই একটা জয় । যদিও এরকম ভাবার কোনো মানেই হয়
না। বাসবী তার কে? কেউ না । ন'বছর আগে এক রাতে সে বাসবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। তারপর
আর কোনো যোগাযোগ নেই । দেখাও হয় না। বাসবী কি সোমনাথের কথা ভেবে ভেবে অন্য কারুর সঙ্গে প্রেম
করেনি। তা হতেই পারে না। সোমনাথ নিজেইতো এর মধ্যে টুকটাক দু'তিনটে ছোট খাটো থ্রেম করে
নিয়েছে। এখন আর তার নীতিবোধ তত দৃঢ় নয়। একটি মেয়ের সঙ্গে গোপনে কিছু খেলাধুলো করাটাকে তেমন
কিছু গুরুত্পূর্ণ ব্যাপার বলেই মনে করে না।
বাসবী তার কেউ নয়, বাসবীর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেনি সোমনাথ, তবু বাসবীর কোনো প্রেমিক আছে, একথা
জানতে পারলে তার ঈর্ষা হতো ।
সোমনাথ নিজের দাম্পত্য জীবনটাকে বেশ সামলে রেখেছে।
শান্তা গান-বাজনা করে, তার একটা নিজস্ব জগৎ আছে। সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতে যায়, তার দুখানা
ক্যাসেটও বেরিয়েছে। সোমনাথ নিজেও একসময় গাইতো, এখন আর চর্চা রাখতে পারে না বটে, কিন্তু সে
নানান গানের অনুষ্ঠান শুনতে যায়। ক্লাসিকাল গান-বাজনার ফাংশন থাকলে সে চেম্বার বন্ধ রেখে দেয়, সারা
রাত শোনে । এই সব সময়ে শান্তা তার সঙ্গে থাকে।
সোমনাথেরও প্র্যাকটিস বেশ জমজমাট, উপার্জন যথেষ্টও বেশি, কিন্তু বাড়াবাড়ি করে না সে । মাঝে মাঝেই
ছুটি নেয়, ছুটি উপভোগ করতেও জানে । প্রতি বছর একবার পাহাড়ে একবার সমুদ্রের ধারে সে বেড়াতে যায়
শান্তাকে নিয়ে।
এখন সে বুঝতে পারে, বাকুড়ার সেই রাতে সে যে বাসবীর স্পষ্ট আহবানেও সাড়া দেয়নি, সেটা তার
কাপুরুষতা নয়, সেটা তার দৃরদর্শিতা। একবার বাসবীকে বুকে জড়িয়ে ধরলে সে আর তাকে ছেড়ে দিতে
পারতো না। তা হলে দুটো সংসার ভাংতে হতো ।
শুধু প্রেমের জন্য অতখানি বিপর্যয় সামলাবার ক্ষমতা ছিল না সোমনাথের ।
তবে, এ কথাও ঠিক, শান্তাকে কিংবা অন্য দু'একটি মেয়েকে সে যখন জড়িয়ে ধরে, থকন বুঝতে পারে,
বাসবীর প্রতি তার যৌন টান ছিল অনেক বেশি তীব্র।
বাসবী আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছে, এবার একবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে কেমন হয়? চিন্তাটা মাথার
মধ্যেই ঘোরে, কিন্তু সত্যি সত্যি যাওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে না সোমনাথ ।
একদিন সে সন্ধ্যোবেলা চেম্বারে বসে রোগী দেখছে, শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, আটটার পর সে আর কিছুতেই
চেম্বারে থাকে না। রোগীরা বসে আছে বাইরে, একজন বেরুলে সোমনাথের সেক্রেটারী নাম ধরে ডাকছে আর
এক জনের ।
একটি যুবক ঢুকলো, বেশ লম্বা ও স্বাস্থ্যবান, মাথায় ঘন চুল, ফর্সা রং, প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট পরা, তার শরীরে
কোনো রোগ আছে বলে মনেই হয় না। যুবকটি এসেই টেবিলের তলায় সোমনাথের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে
পড়লো।
সোমনাথ ত্রস্ত হয়ে বললো, আরে আরে এ কী।
যুবকটি বললো, আপনি ভালো আছেন স্যার?
সোমনাথ মৃদু ধমক দিয়ে বললো, হ্যা, আমি ভালো আছি।
আপনি ওই চেয়ারে গিয়ে বসুন, তারপর বলুন, আপনার কী হয়েছে।
দু'একজন পুরনো রোগী এসে এরকম বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু সোমনাথ এই লোকটিকে চিনতে পারলো না।
আগে কখনো দেখেছে বলেও মনে হয় না।
যুবকটি বললো, স্যার আমার নাম আলতাফ মন্ডল ।
সোমনাথ বললো, হ্যা, নামটা তো শুনলাম, এবার কাজের কথা বলুন । শুধু নাম শুনে তো রোগ বোঝা যাবে
না।
যুবকটি বললো, স্যার, আমি বীকুড়ায় সাইকের রিকশা চালাতাম। আপনি একদিন রাত্রিবেলা...
সোমনাথ চমকে উঠলো তার মনে পড়ে গেল এবার সেই রোগা হাড় জিরজিরে ছেলেটাকেই সে দেখেছে,
পড়েতো আর দেখেনি, সে এখন এরকম সুগঠিত, বলবান পুরুষ হয়ে গেছে? শুধু তাই নয়, তার পোশাক রুচি
সম্মত, মুখখানি মধ্যবিস্ত, জদ্রলোকদের মতন। সে যে একেবারে শ্রেণী পাল্টে ফেলেছে।
সোমনাথ ওর খবর একটু একটু জানতো ।
প্রথম প্রথম বাকুড়া থেকে বীরেশ্বর মাস্টার মশাই চিঠি লিখতেন সোমনাথকে । তিনি এ ছেলেটির ব্যাপার সম্পর্কে
উচ্সিত ছিলেন। নিজে নিজে পড়ে সে একেবারেই পাস করে গেল মাধ্যমিক ।
সেখানেই থামলো না। তৈরি হতে লাগলো উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য । হেড মাস্টার মশাই নিজে ওকে পড়াতেন।
উচ্চ মাধ্যমিক ফার্ট ডিভিশন পেয়ে গেল আলতাফ । স্কুলের পরিবেশে থেকে পড়াশুনায় তার ঝোঁক এসেছিল।
এর কিছু পরেই বীরেশ্বর বাবু মারা যান।
তখন চাকরিটা রক্ষা করার ব্যাপারে কিছু গোলমাল হয়েছিল । অন্য দফতরিরাই শত্রুতা করেছিল তার সঙ্গে।
চাকরি যখন যায় যায় অবস্থা, সেই সময় স্কুলের সেক্রেটারী এসে হস্তক্ষেপ করলেন। দফতরির বদলে কেরানির
পদ দেওয়া হলো তাকে । লাইবেরিয়ানের সহকারী ।
সেখানেই বই পড়ার আরও অনেক সুবিধে । আলতাফের তখন পড়াশুনোর নেশা ধরে গেছে। সে তার ছোট
ভাই-বোনদেরও স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে তাদের বাড়িটা তখন আর রিকশাওয়ালার বাড়ি নয়, দফতরির বাড়ি
নয়, কেরানির বাড়ি।
বিএ পরীক্ষাতেও ভালো রেজাল্ট করলো আলতাফ । অনার্সে হাই সেকেন্ড ক্লাস।
আলতাফ বললো, আমার আরও পড়ার ইচ্ছে ছিল স্যার । ঠিক করেছিলাম, ইকোনমিক্সে এমএ পরীক্ষা দেবো ।
কিন্তু এই সময় রেলের চাকুরির পরীক্ষার একটা বিজ্ঞাপন বেরুলো। অনেকেই বললো, এঁ পরীক্ষাটা দিতে ।
দিয়েছিলাম । ইন্টাভিউতে চানসও পেয়ে গেলাম।
সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, তুমি এখন রেলে চাকুরি করো?
আলতাফ বললো, হ্যা স্যার এখন আর বীকুড়ায় থাকি না। বহরমপুরে কোয়ার্টার পেয়েছি । আমার ভাই-বোন
দুটোও কলেজে পড়ে।
সোমনাথ আলতাফের দিকে তাকিয়ে রইলো । এদেশে কত প্রাণ অকালে নষ্ট হয়ে যায় । কত ছেলে-মেয়ে একটু
সুযোগ পেলে দীড়িয়ে যেতে পরে । কিন্তু সুযোগ পায় না, বঞ্চিত হয়, রোগে ভূগে হারিয়ে যায় । সোমনাথ তার
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অন্তত একজনকে, দু'তিন মাসের মধ্যে মৃত্যু ছিল যায় অবধারিত, সে এখন সুস্থ,
স্বাভাবিক মানুষ ।
সোমনাথের সবচেয়ে ভালো লাগলো আলতাফের স্বাস্থ্য দেখে । সে একজন রীতিমত বলশালী যুবক, কে বলবে
যে একসময় টিবি রোগে ভুগে এমন চেহারা করেছিল, যখন ওর বুকের সবকটা পাজরা গোনা যেত।
আলতাফ বললো, স্যার, সেই রাতটার কথা আমি কোনো দিন ভুলবো না, ২৪ শে জুলাই, ১৯৯২ সাল, খুব
বৃষ্টি পড়ছিল, আমার খুব জর, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ে, তবু রিকশা চালাতেই হয়, না হলে খেতে পাবো না,
সেই সময় আপনার বদলে যদি আমি অন্য কোনো প্যাসেঞ্জার নিতাম, তা হলে হয়তো আমি আর বাচতাম না।
সোমনাথের শরীরে একটা শিহরন হলো । এ তারিখটা তার মনে থাকার কথা নয়। তবু মনে আছে। বাসবী এ
তারিখটার কথা উচ্চারণ করেছিল । সেই রাতে বাসবী সব ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছিল, সোমনাথ প্রেমিক হতে
পারেনি, হয়েছিল কাপুরুষ । বাসবীর শেষ কথাটাই সোমনাথের মাঝে মাঝে মনে পড়েছে, আলতাফের কথা সে
ভুলেই গিয়েছিল।
আলতাফ আবার বললো, অনেকে বলে, আমার বেঁচে যাওয়াটা একটা মিরাকল। আপনার কাছে পঞ্চাশ টাকা
চেয়েছিলাম, আপনি আমাকে ওপরে ডেকেছিলেন, বারান্দার আলোতে আপনি আমার মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন, আমার কতখানি অসুখ, আপনি বৃষ্টির মধ্যে আমায় বাড়ি ফিরতে দিলেন না, ওষুধ দিলেন, ভাত
খেতে দিলেন, সেই জন্যই তো আমি বেঁচে গেলাম ।
নিজের প্রশংসা শুনতে চায় না সোমনাথ । তার অস্বস্তি হয়। সে হাত তুলে থামিয়ে বললো, আমি আর এমন কী
করেছি। ওরকম সবাই করে।
আলতাফ জোর দিয়ে বললো, না স্যার, সবাই করে না। আরও তো ডাক্তার বাবুরা রিকশায় চাপেন। কেউ
আমাদের সঙ্গে কথাই বলতেন না। অন্য রিকশাওয়ালাদের অসুখ করে । আর কোনো ডাক্তার বাবু তো তাদের
কারুকে সাহায্য করেন না। আপনি যুদি আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতেন ...
সোমনাথ বললো, আমি শুধু তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি, কিন্তু তোমাকে আসল সাহায্য করেছেন বীরেশ্বর
মাস্টার মশাই । তিনি যদি তোমাকে ওই চাকরিটা জুটিয়ে না দিতেন...
আলতাফ বললো, মাস্টার মশাইয়ের একখানা ছবি আমি ঘরে টাঙ্গিয়ে রেখেছি। কিন্তু ওনাকেও তো আমার
চাকরির কথা আপনিই বলেছিলেন, না হলে কি উনি আমার কথা জানতে পারতেন?
মাস্টার মশাইও সব সময় বলতেন এই কথা।
সোমনাথ বললো, যাই হোক আলতাফ তুমি পুরোপুরি সুস্থ আছো, জীবনে দীড়িয়ে গেছ দেখে খুব ভালো
লাগলো।
আলতাফ ওঠার ইঙ্গিতটা গ্রাহ্য করলো না।
সে বললো, অনেক আগেই আপনার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল। এর আগে আপনাকে দু'খানা চিঠি লিখেছি,
উত্তর পাইনি ।
চিঠিপত্র সোমনাথ নিজে খোলে না, তার সেক্রেটারির ওপর ভার দেওয়া আছে। অপ্রয়োজনীয় চিঠি সে
সোমনাথকে দেখায় না। বাংলায় লেখা ধানাই-পানাই করা চিঠি সে গ্রাহ্য করেনি বোঝা যাচ্ছে।
এড়িয়ে যাবার জন্য সোমনাথ বললো, হ্যা, অনেক চিঠি আসে... আলতাফ বললো, আমার মা আমাকে প্রায়ই
বলে, তুই ডাক্তার বাবুর সঙ্গে একবারও গিয়ে দেখা করলি না? তুই এমন নিমকহারাম ৷ আসলে চিঠির উত্তর
না পেয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কোথায় দেখা করবো।
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আলতাফ এবার একটা ছোট প্যাকেট বার করলো, মোড়কটা খোলার পর দেখো
গেল, তারমধ্যে রয়েছে একটা ভেলভেটের বাকস। সেটা সন্্রমে এগিয়ে দিল সোমনাথের দিকে ।
সোমনাথ নিছক কৌতৃহলে বাকসটা খুললো । বেশ চমকে গেল সে, রীতিমতন দামি একটা আংটি । অনেকখানি
সোনার, তাতে তিনটি মুক্তো বসানো।
সোমনাথ তার দুই হাতের পাঞ্জা টেবিলের ওপর রেখে বললো, এটা নিয়ে আমি কি করবো? আমি কি আংটি
পরি? এই দ্যাখো । আমি আর্ট পরা একেবারেই পছন্দ করি নয়!
আলতাফ কাচুমাচু হয়ে বললো, স্যার, মা পাঠিয়েছেন । আপনি আংটি পরেন না, বউদিকে দেবেন।
_বউদির অনেক আংটি আছে।
-তা হলে এমনিই বাড়িতে রেখে দেবেন।
-বাড়িতে সোনার গয়না গড়িয়ে কারা রাখে? যারা মনে করে কখনো বিপদে পড়লে এঁ সোনা বিক্রি করবে।
আমার সে রকম বিপদে পড়ার ঝুঁকি নেই। আমি যদি আজ হঠাৎ মরেও যাই, আমার স্ত্রীকে সোনা বিক্রি করে
খেতে হবে না। এটা নিয়ে যাও। আমাকে কখনো কিছু দেবার চেষ্টা করবে না। নতুন চাকরিতে ঢুকেছো, এত
দামি আংটি কিনে বাজে খরচ করার কোনো মানে হয়?
আলতাফ বললো, আমার চাকরিটা ভালো । শিগগিরই নিজের বাড়ি করার জন্য জমি কিনবো ভাবছি।
সোমনাথ কয়েক মুহুর্ত চেয়ে রইলো আলতাফের দিকে । উপরি, মানে ঘুষ? কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল
সোমনাথ । একজন পেশেন্ট তার চাকরিতে ঘুষ নেবে কি নেবে না, সে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া বোধ হয়
ডাক্তারের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
আলতাফ বললো, আমি জানতাম, আপনি এটা নেবেন না, মাকে বলেছিলাম সে কথা । আমি আর একটা জিনিষ
ঠিক করেছি স্যার ৷ অনেক গরিব লোকের টিবি হলেও চিকিৎসা হয় না। কীচাড়াপাড়া টিবি হাসপাতালে প্রত্যেক
বছর আমি একজন করে রোগীর চিকিৎসার খরচ দেবো ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন