একা না দোকা

"আর আমি একা পারছিনা দীপ, এবার বিয়েটা কর। বয়স তো অনেক হল। তোর বয়সী সবাই বিয়ে করে বাবা হয়ে গেছে। অফিসে যাদের সাথে থাকিস তারাও তোর থেকে ছোট হয়ে বৌ বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে।"

"উফ্, মা সব সময় বিয়ে বিয়ে কোরো না তো। বিয়ে মানেই তো স্বাধীনতা শেষ। খালি দোকান, বাজার আর কুলিগিরি করা। তার থেকে এই ভালো আছি।"

"৩৯ বছর বয়স হল তোর। সেটা খেয়াল আছে? আমি আর কত দিন!"

"বাজে কথা না বলে যাও টিভি দেখ।"

 রাতে ব্যাগ গুছিয়ে শুতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেছে দীপের। কাল অফিসের বন্ধুদের সাথে পুরী ঘুরতে যাবে। বন্ধু না বলে ভাই বললেই ভালো হয়। সবাই ওর থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। কিন্তু একসাথে চাকরি করে বলে বন্ধু বলেই পরিচয় দেয়। ওরাও দাদা না বলে নাম ধরেই ডাকে। ইয়ার্কি, ফাজলামো বন্ধুদের মতোই হয়।

 তিনদিনের ট্যুর। জিনিস খুবই কম। তবু নিজে গোছাতে একটু সময় লেগে গেল। মাকে বলতে পারত। কিন্তু তাতে ওখানে গিয়ে অসুবিধেতে পড়তে হত। কি দিতে কি ভুলে যেত তার ঠিক নেই। আসলে অফিস থেকে ফিরে রোজ একটু ক্লাবে যায় ক্যরাম খেলতে। আজও গেছিল। তাই একটু দেরি হল।

কথা মতো রাত ন'টার ভিতরে দীপ স্টেশনে পৌঁছে গেছে, ১০.৪০ এ ট্রেন। কিন্তু জয় ছেড়ে আর কেউ এখনো পৌঁছায়নি। পুরো টিমের ভিতরে একমাত্র সে আর জয় অবিবাহিত। বাকি সুজয়, বিপিন, অনুপম, জয়ন্ত এরা সবাই বিবাহিত। বিপিনের তো একটা তিন বছরের ছেলেও আছে। ওরা সবাই বৌ বাচ্চা নিয়েই যাচ্ছে। ওদের সবার দেরি হচ্ছে দেখে দীপ বলল,

"দেখেছিস, এই জন্য বিয়ে করতে চাই না। একা থাকার কি সুখ তা মানুষ বিয়ের পর বোঝে। আর আমি আমার বিবাহিত বন্ধুদের দেখেই বুঝেছি। তাই ওই ভুল আর করছি না।"

কথা শেষ হতেই পিছনে তাকিয়ে দেখে বিপিন আসছে। দু'হাতে দু'টো বিশাল বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ভালো করে হাঁটতে পারছে না। বৌ কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ছেলেকে ধরে ওর পিছনে পিছনে আসছে। জয় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ধরল ওর একটা ব্যাগ। কাছে আসতেই দীপ বলল,

"তিন দিন ঘুরতে এতো কি নিয়েছিস? আমার তো এই ছোট্ট একটা ব্যাগেই সব ধরে গেছে।"

"তুই আর আমি কি এক হলাম! তুই একা, আর আমরা তিন জন। তার উপর ছেলেটা ছোট। ওর কত কি লাগে।"

একে একে সুজয়, অনুপম আর জয়ন্ত চলে এলো। ওদেরও বড় বড় দু'টো করে ব্যাগ হয়েছে। জয় বলল,

"হ্যাঁ রে, বিপিনের না হয় ছেলের জন্য এতো গুলো ব্যাগ। তা তোদের এতো বড় ব্যাগ হল কেন?"

অনুপম হেসে বলল,

"আর বলিস না ভাই! বৌ বলে তিন দিনে ছ'টা জামা পরবে। তার পর একটা পরে স্নান করবে, একটা পরে ঘুমাবে। উফ্ বৌ থাকা যে কি ঝক্কি বুঝবি না ভাই। তোরাই ভালো আছিস।"

"আচ্ছা, নিজের বুঝি কিছু নাওনি! যত দোষ আমার! এবার যখন বেড়াতে যাব তখন তোমার কিছু নেব না। দেখবে ব্যাগ একটা কমে যাবে।"

অনুপমের বউয়ের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

ট্রেনে উঠে গল্প করতে করতে যে যার বিছানা করছে। বৌ'রা একটা সিটে বসে গল্প করছে। বিছানা হয়ে গেলে যে যার শুয়ে পড়ল। ওদের দেখে অবাক লাগছে দীপের। বর গুলো কেমন বিছানা করে দিল, আর বৌ গুলো কি সুন্দর গিয়ে শুয়ে পড়ল। এই জন্যই বিয়ে করতে ইচ্ছা হয় না ওর। ছেলেরা বিয়ের পর কেমন গোলাম টাইপের হয়ে যায়। একবার এটা গুছায়, একবার ওটা গুছায়। ব্যাগ থেকে বৌ কে জিনিস খুঁজে দেয়। ঘুরতে গিয়ে পুরো কুলি হয়ে যায়। দেখে দেখে অসহ্য লাগে ওর।

দীপের খুব ইচ্ছা ছিল ওখানে দু'টো ঘর নেওয়ার। একটাতে ছেলেরা আর একটাতে মেয়েরা থাকবে। কিন্তু বিপিন রাজি হল না। ছেলেটা রাতে অনেক বার ওঠে। তাই বৌ একা সামলাতে পারবে না। অনুপম আর জয়ন্ত ও রাজি নয়। পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে পরিবারকে আলাদা রাখার পক্ষপাতি তারা নয়। অগত্যা সে আর জয় একটা ঘর নিল, আর বাকিরা আলাদা আলাদা ঘর নিল। 

দুপুরে সমুদ্র স্নান সেরে ছেলেরা আড্ডা দিতে বসলে মেয়েরা বেড়িয়ে পড়ল কেনাকাটা করতে। এই সুযোগে দীপ বাকিদের জিজ্ঞাসা করল,

"হ্যাঁ রে, তোরা বৌ বাচ্চা নিয়ে বোর হোস না? রাত জেগে বাচ্চা সামলাস, বিছানা করিস, কুলি গিরি করিস, বিরক্ত লাগেনা তোদের?"

বিপিন হেসে বলল,

"অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পর ছেলে যখন বাবা বলে গলা জড়িয়ে ধরে তখন নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হয়। বৌ সারাদিন ওই বাচ্চার সব ঝামেলা সামলায়। তার উপর সংসারের চাপ। রাতে ওকে একটু বিশ্রাম দিই। মেয়ে হলেও মানুষ তো।"

অনুপম বলল,

"সারা বছর সংসারে কুলি গিরি করছে বৌ গুলো। এক দিন বাড়ি থাকলে বুঝবি ওদের কি জ্বালা। আমার বৌ তো অফিস যায় রান্না করে, আবার ফিরেই রান্না ঘরে ঢোকে। মা বাবার কখন কি প্রয়োজন আমার থেকে ওই ভালো জানে। তাই বিছানাটা রোজ আমিই করি। এটুকু করলে নিজে শান্তি পাই। কিছু তো একটা করলাম। আসলে কি জানিস ভাই, দু'জন দু'জন কে না বুঝলে সংসার হয় না। ওরা সব ছেড়ে এসেছে আমাদের কাছে। ওদেরও তো কিছু চাহিদা, ইচ্ছা, শখ থাকে। সব পূরণ করতে না পারি যে টুকু পারি তাই শান্তি।"

"আচ্ছা অনুপম আগে তো বলতিস রোজ সন্ধ্যেবেলা ক্লাবে যাস। বিয়ের পর নিশ্চয়ই আর যাস না। গেলে বৌ রাগ করবে। তা বৌদের এই অন্যায় আবদার গুলো মানতে ভালো লাগে?"

"তোর প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি দীপ। আগে আমার একটা কথার উত্তর দে। রোজ যদি বাড়ি ফিরে দেখিস তোর মা পাশের বাড়ির কারুর সাথে গল্প করতে গেছে, তুই ফেরার পরেও মা ফিরছেন না। রাত ১০ টায় এসে খালি খেতে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন। কেমন লাগবে তোর? নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। বাড়ির বৌদের তাহলে কি করে প্রতি দিন সন্ধ্যে বেলা একা থাকতে ভালো লাগবে? ওরাও তো সারাদিন পর আমাদের সাথে একটু সময় কাটাতে চায়। তবে মাঝে মাঝেই যাই ক্লাবে। তখন বৌ রাগ করে না। আসলে সবার দিকটা ভাবতে হয়।"

এই তিন দিনের ঘোরাতে অনেক কিছু শিখল দীপ। স্বামী স্ত্রী যে কোনো ভালো জিনিস কেমন ভাগ করে খায়। ভিড়ের মধ্যে কেমন সামলে রাখে একে অপরকে। একজনের মনের ইচ্ছা কি অদ্ভুত ভাবে আর একজন বুঝতে পারে। সত্যি কি অসাধারন একটা সম্পর্ক যেখানে দুঃখ, রাগ, ভালোবাসা, মান-অভিমান সব আছে শুধু সে গুলোকে দুটো মানুষ মিলে মিশে ভাগ করে নিতে জানতে হয়।

ট্রেনে কলকাতা ফেরার সময় দীপ দেখল বৌ গুলো সব কেনাকাটার লিস্ট খুলে বসেছে। বাড়ির সবার জন্য কিছু না কিছু কিনেছে। আর তাই দেখে ছেলে গুলো সমানে কৃত্রিম সুরে ঠাট্টা করে যাচ্ছে। সত্যি ওদের ভিতরের হাসি ঠাট্টা, ভালোবাসা আজ বিয়ে সম্পর্কে দীপের ধারণা বদলে দিয়েছে অনেকটা। কেমন যেন তার মনে হচ্ছে জীবনের অনেক বড় একটা অধ্যায় ওর অজানা রয়ে গেছে। ওই অজানা অধ্যায়টা জানার জন্য আজ মনটা কেমন উতলা হচ্ছে। না এবার মা বললে আর না করবে না সে। কিছু ঝক্কি পোহাতে মনে হয় ভালই লাগে।

- অতসী দাস

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন